কৃষকের আর্থিক উন্নয়নে মজাপুকুরে সমন্বিত সবজি ও মাছ চাষ
ড. সত্যেন ম-ল১ এবিএম মোস্তাফিজুর২ বীর জাহাঙ্গীর সিরাজী৩
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নগরায়নের কারণে সবজি ও মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে, সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে কৃষি জমির রূপান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের পরিবেশগত প্রভাবের কারণে খাদ্য সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে। সুতরাং, একটি টেকসই বিকল্পের জরুরি প্রয়োজন। মজা পুকুরে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ পদ্ধতি এমন একটি বিকল্প উৎপাদন প্রযুক্তি, যেখানে টেকসই উপায়ে জমি ও জলের যথাযথ ব্যবহার করে অধিক সবজি ও মাছ উৎপাদন করা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি পরিবেশগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মাটির উর্বরতা বাড়ায়, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, পরিবেশগত স্থায়িত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করে, জীববৈচিত্র্য বজায় রাখা এবং মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে ।
বাংলাদেশে সমন্বিত ধান-মাছ চাষ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত তবে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ প্রযুক্তির সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো অন্বেষণ করা প্রয়োজন। সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়, একটি জীবিকানির্ভর চাষ পদ্ধতি। শুধুমাত্র মাছচাষ বা শুধুমাত্র সবজি উৎপাদনের তুলনায় এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের পুষ্টির সংস্থানের পাশাপাশি আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো অপেক্ষাকৃত সহজ।
খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে শাকসবজি, ফলমূল ও মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের ১৪ মিলিয়ন বসতবাড়ির প্রায় ৯০ ভাগ এর গড় আয়তন ৮১০ বর্গমিটার । বসতবাড়ির অনেক এলাকায় একটি পুকুর রয়েছে এবং বসতবাড়ির পুকুর পাড়ের চারপাশে যথেষ্ট পতিত জমি রয়েছে যা সবজি ও ফল উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অনেক পুকুর অগভীর হয়ে যায় এবং শুধুমাত্র বর্ষাকালে পানিতে ভরে যায়। এইসব অগভীর মজা পুকুরে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ করে, একটি প্রান্তিক বা ছোট পরিবার পর্যাপ্ত শাকসবজি এবং মাছ উৎপাদন করতে পারে। এই পদ্ধতিতে ছোট পুকুরের পাড়ে সারা বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বা ফল চাষ করা যায়। সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ পদ্ধতিতে একই সাথে বা পর্যায়ক্রমে মাছের সাথে পুকুরে কচু চাষ করা যায়, যা কিনা পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে অর্থনৈতিকভাবে যেকোন পরিবারকে সচ্ছল করতে সাহায্য করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য আমাদের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসডিজি অর্জন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একই উৎপাদন পদ্ধতি থেকে সবজি ও মাছ উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। আমরা টেকসই পদ্ধতিতে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ এর মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পুকুর পাড়ে সবজি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গাসহ অন্তত একটি মৌসুমি বা পরিত্যক্ত পুকুর আছে এমন কৃষকভাইদের এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে পারি। তাই ফসলের বহুমুখীকরণ এবং ফলন সর্বাধিক করার জন্য মিনিপুকুরে সবচেয়ে লাভজনক আধা জলজ চাষ পদ্ধতিতে এই প্রযুক্তিটি সারা দেশে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য
প্রযুক্তিটি বসতবাড়ি সংলগ্ন মজা পুকুরের (১ মিটার গভীরতা) জন্য উপযোগী। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একজন কৃষক তার একখ- জমি থেকে সবজি, মাছ ও ফল উৎপাদন করতে পারে। পুকুরে পানিকচু+মাছের সমন্বিত চাষ করা হয় এবং একই সাথে পুকুরের পাড়ে পেঁপে ও মাচা করে সারা বছর সবজি চাষ করা হয়। বারি পানিকচু-৩ এবং মাছ হিসেবে তেলাপিয়া এই প্রযুক্তির জন্য খুব উপযোগী। প্রযুক্তিটি লাভজনক এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে।
প্রযুক্তির উপযোগিতা
এই প্রযুক্তিটি সমগ্র বাংলাদেশে যেখানে অগভীর (১ মিটার পর্যন্ত) মজা পুকুর পরিত্যক্ত অথবা স্বল্প ব্যবহৃত রয়েছে সেই সমস্ত এলাকার জন্য উপযোগী। প্রযুক্তিটি পরিত্যক্ত পুকুর খনন না করেও সর্বোচ্চ ব্যবহারের আওতায় আনা যায়। এ ছাড়া অনুরূপ অব্যবহৃত জলজ পতিত জমি এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে মজা পুকুরে বারি পানিকচু-৩ এর চারা রোপণ করা হয়ে থাকে। চারা রোপণের আগে জমি তৈরির সময় প্রতি শতক জমিতে ৪০-১.২-০.৬-১.২-০.৪ কেজি হারে যথাক্রমে গোবর-ইউরিয়া-টিএসপি-জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। একই সময়ে পুকুরের পাড়ে মাদা করে পেঁপের চারা রোপণ করতে হবে। পানিকচু রোপণের প্রায় ৬০ দিন পরে বৃষ্টির জমা পানিতে অথবা সেচ দিয়ে কচুর ভেতরে মাছের পোনা ছেড়ে দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে ২টি (শতাংশে ৮০টি) তেলাপিয়া মাছ ছাড়া হয়। তেলাপিয়া মাছের জন্য প্রায় এক মিটার পানির গভীরতাই যথেষ্ট, পানির গভীরতা বেশি হলে কচুর বৃদ্ধিতে অসুবিধা হয়। পুকুরের পাড়ে খরিফ (চিচিঙ্গা, ঝিঙা, করলা, চাল কুমড়া) ও রবি (লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, বরবরটি) মওসুমে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করা হয়ে থাকে। এ জন্য প্রতিটি সবজির জন্য মাদা তৈরি করে লতানো সবজির মাচা পুকুরের পানির পাড়ের পাশে তুলে দিতে হবে। সবজিতে সেচ ও অন্যান্য পরিচর্যা প্রয়োজন মতো দিতে হবে। কচু রোপণের ৬০ দিন পর হতে পানিকচুর লতি সংগ্রহ করা যায়। জুন মাস হতে পানিকচু সংগ্রহ করা যায় এবং আগস্ট মাসের মধ্যে সংগ্রহ সম্পন্ন হয়ে যায়। পুকুরের পানি কমে আসলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মাছ সংগ্রহ করা হয়। পুকুর রবি মওসুমে ব্যবহারের জন্য পুকুরের স্বল্প পানিকে কাজে লাগিয়ে ছালার বস্তায় মাটি ভরে রবি মওসুমের সবজি হিসেবে শিম ও লাউ চাষ করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে পুকুর থেকে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল সংগ্রহ করা হয়।
প্রযুক্তি হতে ফলন/প্রাপ্তি
উক্ত প্রযুক্তি অনুসরণের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ (৬০০ বর্গমিটার) আয়তনের একটি মজা পুকুর থেকে প্রায় ৬০,৩০০/- টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। পতিত মজা পুকুরে কেবল তেলাপিয়া মাছ অথবা পাড়ে কেবল সবজি চাষ পদ্ধতির তুলনায় এই উন্নত প্রযুক্তিটি প্রায় ২৯৫ ভাগ অধিক মুনাফা অর্জনে সক্ষম। প্রযুক্তিটি সুষম খাদ্য সরবরাহ করে পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : ১সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৩ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। মোবাইল- ০১৭১২৪০৫১৪৯, ই-মেইল- satyen1981@gmail.com